সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১২ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক : তরুণ থেকে যুবক, নানা বয়সের মানুষগুলোর স্বপ্ন ইউরোপ। বিপদসংকুল পথ জেনেও ঘর ছাড়েন। তবে, ভয়ঙ্কর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এদের বেশিরভাগের স্বপ্ন আর পূরণ হয় না। শুধু তাই নয়, জীবন প্রদীপ নিভে যায় অকালে। মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে খোয়াতে হয় পরিবারের শেষ সম্বলটুকুও। সড়ক ও আকাশপথ ধরে বাংলাদেশ থেকে ইতালিসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে যেতে তাদের প্রথম গন্তব্য লিবিয়া। লিবিয়া পৌঁছানোর পর পাড়ি দিতে হয় ভয়ঙ্কর ভূমধ্যসাগর। সেখান থেকে ইতালি ও আশপাশের ইউরোপের দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা থাকে তাদের। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভনে এমন শত শত মানুষের স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটে ভূমধ্যসাগরে। অবৈধ পথে ইউরোপ যাত্রার পরতে পরতে এমন মৃত্যুফাঁদ জেনেও বাংলাদেশি একটি চক্র লিবিয়া নিয়ে যাচ্ছে তাদের।
অবৈধ পথে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত তিনজনকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে ভয়াবহ তথ্য। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে থাকা ‘গুডলাক ভাই’ নামে কথিত এক বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগর হয়ে অবৈধ পথে ইউরোপে মানব পাচার চক্রটির মূলহোতা বলে জানা গেছে। লিবিয়া ও বাংলাদেশ থেকে চক্রটি তাদের কাজ চালায়। মূলত তিন ধাপে তাদের ইউরোপ পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। প্রথম দুই ধাপে সরাসরি যুক্ত থাকে বাংলাদেশি চক্রটি। তৃতীয় ও শেষ ধাপে লিবিয়ার লোকজন নৌকায় করে তাদের ভূমধ্যসাগর পার করানোর চেষ্টা করে। বাংলাদেশ ও লিবিয়া দুই দেশ মিলিয়ে অন্তত ১০০ জন এই চক্রের হয়ে কাজ করে বলেও র্যাব ও গোয়েন্দা সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কোটি কোটি টাকার অবৈধ এই ব্যবসায় ঢাকা ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকে চক্রটির এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। তবে ইউরোপে মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকা তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর এই চক্রের মূলহোতা ‘গুডলাক ভাই’ সম্বন্ধে জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই চক্রের বাকিদের ধরতে এর মধ্যে ঢাকা ও বিভিন্ন এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
মানবপাচারকারী চক্রটি বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ লোক পাঠাতে তিনটি রুট ব্যবহার করে। প্রথমে, ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে লিবিয়াতে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইস্তাম্বুলে পাঠানো সম্ভব না হলে আকাশ বা সড়কপথে ভারতে নিয়ে পরে সেখানে পাঠায়। সবশেষ ধাপটি তুলনামূলক ব্যয়বহুল। প্রথম দুটি রুটে কাজ করা না গেলে, তৃতীয় রুটে লোক পাঠায় মানবপাচারে চক্রটি। এই রুটে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপগামীদের পাঠানো হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। দুবাই থেকে আকাশ পথে যেতে হয় জর্ডান। মূলত সেখান থেকে আকাশ বা সড়কপথে ইউরোপগামীদের পাঠানো হয় লিবিয়ায়। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ যেতে ইচ্ছুক এসব মানুষদের লিবিয়া পৌঁছানোকে প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করে মানব পাচার চক্র। লিবিয়ার ত্রিপোলিতে পৌঁছানোর পর তাদের দেখভাল করে কথিত বাংলাদেশি ‘গুডলাক ভাই’।
এই গুডলাক ভাইয়ের আসল নাম নাসির উদ্দিন, বাংলাদেশের নোয়াখালীতে তার গ্রামের বাড়ি বলে জানতে পেরেছে গোয়েন্দারা। নাসির উদ্দিনের ছোট দুই ভাই মনজু ও রিপন এই চক্রের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করে। নাসির উদ্দিন ওরফে গুডলাক ভাই দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে বসেই চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার দুই ভাই মনজু ও রিপন কখনো লিবিয়া আবার কখনো বাংলাদেশে বসে পুরো প্রক্রিয়া দেখভাল করে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, লিবিয়া পৌঁছানোর পর দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু করে ‘গুডলাক ভাই’র গ্যাং। ত্রিপোলি থেকে এসব ইউরোপগামীদের নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ার উপকূলীয় এলাকায়। ভূমধ্যসাগরের পাড়ের নিরাপদ এলাকা থেকে নৌযানে করে তাদের পাঠানোর চেষ্টা করা হয় ইতালি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে। তবে ভূমধ্যসাগর উপকূলে আরেক চক্রের হাতে এসব বাংলাদেশিদের তুলে দেয় ‘গুডলাক ভাই’। এখানে শুরু হয় তাদের কথিত ‘গেইম’ ট্র্যাপ।
চক্রটি ভয়ঙ্কর ভূমধ্যসাগরের জলপথ পাড়ি দেয়ার এই জীবন-মরণ খেলার নাম দিয়েছে ‘গেইম ট্র্যাপ’। মূলত লিবিয়ার উপকূলীয় এলাকায় ইউরোপে যেতে ইচ্ছুক মানুষদের ‘গেইম ট্র্যাপে’ বিদায় জানায় বাংলাদেশি নাসির উদ্দিন। এমন বিদায় জানানোর প্রক্রিয়া থেকে নাসির উদ্দিনের নাম হয়ে যায় ‘গুডলাক ভাই’। পাশাপাশি এই নামেই পরিচিত হয় চক্রটি। লিবিয়ার উপকূল থেকে ইউরোপ পৌঁছাতে দায়িত্ব দেয়া হয় লিবিয়ার আরেক চক্রকে। তাদের দায়িত্ব ইউরোপগামীদের ইতালি ও আশপাশের দেশে প্রবেশে সহায়তা করা। তবে, এমন ভয়ঙ্কর চেষ্টায় অনেকে সাগরেই মারা যায় বলে এই পথে যাত্রার নাম গেইম ট্র্যাপ। পুরো প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে আট থেকে দশ লাখ টাকা দিতে হয় ‘গুডলাক ভাই’ চক্রকে। তবে লিবিয়ায় বসে নিয়ন্ত্রণ করলেও দেশের নানা প্রান্তে পাচারকারীদের এজেন্ট ছড়িয়ে আছে বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব এজেন্ট জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিদেশ যেতে আগ্রহীদের টোপ ফেলে। ইউরোপ যেতে ইচ্ছুকদের সঙ্গে পাচার চক্রের সদস্যদের সাথে দেখা করিয়ে দেয় লোকাল এজেন্টরা। ইউরোপগামীদের পাচার চক্রের হাতে তুলে দিলে এজেন্টদের পকেটে আসে অর্থ, জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা।
তবে, লিবিয়ায় বসে নিয়ন্ত্রণ করলেও গুডলাক ভাই চক্রের বাংলাদেশি সদস্যদের ধরতে এর মধ্যে র্যাব নজরদারি শুরু করেছে বলে জানা গেছে। মানবপাচার চক্রের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম মানবজমিনকে বলেন, এই চক্রের নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত। আমরা পুরো নেটওয়ার্ক ভেঙে সবাইকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছি। র্যাব জানায়, পৃথক আরেকটি চক্রের হোতা মিরাজ হাওলাদার। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার বাসিন্দা মিরাজ লিবিয়ায় বসে চক্রটির মাধ্যমে ইউরোপ পাঠানোর নামে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া সেখানে আটকে রেখে নির্যাতনের মাধ্যমে দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মিরাজের চক্র। এই চক্রের বিরুদ্ধে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে অসংখ্য ভুক্তভোগী অভিযোগ দিয়েছে বলে জানা গেছে। এসব বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান গতকাল রাতে মানবজমিনকে বলেন, চক্রের বাকি সদস্যদের ধরতে কার্যক্রম চলছে। সিলেটে ও শরীয়তপুরে মানবপাচার আইনে দুটি আইনে মামলা হয়েছে। যাদেরই জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে আমরা তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।
উল্লেখ্য গত ৯ই মে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে অন্তত ৪০ বাংলাদেশী নিখোঁজ রয়েছেন। একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ৪০ জনের সবাই পানিতে ডুবে মারা গেছেন। দুটি নৌকায় করে ১৩০ বাংলাদেশী ইতালি যাত্রা করেছিলেন লিবিয়ার ত্রিপলী উপকূল থেকে। একটি নৌকা ইতালি উপকূলে পৌঁছতে পারলেও অন্যটি ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায়।